বরগুনার আমতলীর চাওড়া নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করন, কচুরীপানা অপসারন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন থেকে আড়পাঙ্গাশিয়া, ঘটখালী ও পৌরশহর রক্ষার জন্য বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭২৬ কোটি টাকা ডিপিপি (ডকুমেন্ট অফ প্রজেক্ট প্রফর্মা) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি চুড়ান্ত পর্যায়ে সচিবের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। সচিব অনুমতি দিলেই দ্রুতই প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে।
বরগুনা পাউবো সূত্রে জানাগেছে, উপজেলার সুবান্দি, রামজী, ঘুঘুমারী খাল সংস্কার ও উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের বালিয়াতলী বেড়িবাঁধ ও নদী ভাঙ্গন রোধ, চাওড়া ইউপির ঘটখালী বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণ ও নদী ভাঙ্গন রোধ এবং আমতলী পৌর শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণসহ এ প্রকল্পের মধ্যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ পুনঃনির্মাণ, শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ, সুবান্ধী খালে ১০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, লোচা খালে ৫ ব্যান্ডের স্লুইজ, সোনাগজা খালে ৩ ব্যান্ডের স্লুইজ, সেনেরহাট বাজারে ২ ব্যান্ডের স্লুইজ ও পূর্বচিলার নয়াভাঙ্গুলীতে ২ ব্যান্ডের স্লুইজ নির্মাণ, ছুরিকাটা মহাসড়ক, হলদিয়া বাজার সংলগ্ন, বলইবুনিয়া খালের গোড়ায়, লক্ষিরখালের গোড়ায়, চন্দ্রাপাতাকাটা ও কাউনিয়া বাঁধসহ ১০টি স্থানে কালভার্ট নির্মাণ, পশ্চিম ঘটখালী ও কৃষ্ণনগর গ্রামে ২টি আউটলেট নির্মাণ ও কচুরীপানা উত্তোলনের জন্য বরগুনা পাউবো ৭২৬ কোটি টাকার ডিপিপি (ডকুমেন্ট অফ প্রজেক্ট প্রফর্মা) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয়ে জমা দিয়েছেন। মন্ত্রানালয় চুরান্ত অনুমোদন দিলেই এ কাজগুলো শুরু করা হবে বলে বরগুনা পাউবো জানিয়েছে।
উল্লেখ্য বরগুনার আমতলী উপজেলার চাওড়া, হলদিয়া, কুকুয়া, সদর ইউনিয়ন ও পৌরসভার উপরদিয়ে প্রবাহিত ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২০০ মিটার প্রস্থ্য ত্রিভুজ আকৃতির চাওড়া- সুবান্দি নদী ও উহার শাখা খালগুলো কচুরীপানায় ভরপুর হয়ে গেছে। ওই নদী ও শাখা খালের পানি পঁচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ দুষিত হওয়ায় চার ইউনিয়ন ও পৌরসভার লাখো মানুষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানাগেছে, ১৯৮২ সালে আমতলীর চাওড়া ও পায়রা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনের হাত থেকে আমতলী শহরকে রক্ষায় সংযোগস্থল চৌরাস্তায় পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে। কালের বিবর্তনে চাওড়া নদী মরা নদীতে পরিনত হয়। ত্রিভুজ আকৃতির ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২০০ মিটার প্রস্থ এ নদীটি উপজেলার হলদিয়া, কুকুয়া, চাওড়া, সদর ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৩০টি গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত। নদীর ভৌগলিক অবস্থানের কারনে সুবান্দি অংশে রামনাবাঁধ নদী, ঘুঘুমারী অংশে টিয়াখালী ও আমতলীর অংশে পায়রা (বুড়িশ্বর) নদীর সাথে সংযোগ রয়েছে। প্রকৃতিক জলোচ্ছাস ও লবনাক্ততার হাত থেকে মানুষ ও সম্পদ রক্ষায় ২০০৯ সালে রামনাবাঁধ নদীর একাংশ সুবান্দি নামক স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে। এরপর চাওড়া ও সুবান্দি নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ওই পয়েন্টে দু’ব্যান্ডের একটি স্লুইজগেট নির্মাণ করেন। স্লুইজগেট নির্মাণ করলেও ৩০ কিলোমিটার লম্বা এবং প্রায় ২০০ মিটার প্রশস্ত খালের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে দু’ব্যন্ডের স্লুইজগেট কোনভাবেই যথার্থ নয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণে লবন পানি প্রবেশের অজুহাত তুললেও বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন নদীগুলোর লবনাক্ততা বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ের একটি বেসরকারী সংস্থার প্রতিবেদন (স্ট্যাডি) বলছে, পায়রা (বুড়িশ্বর), বিষখালী এবং বলেশ্বর মোহনায় মার্চের প্রথম থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত লবনাক্ততা থাকলেও তালতলীর পর পায়রা নদীতে লবনাক্ততা সহনীয় মাত্রার এবং বগি বাজারের পর থেকে লবনাক্ততা খুব কম। আন্দারমানিক এবং রামনাবাদ চ্যানেলের লোন্দা পয়েন্ট পর্যন্ত মার্চের থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত লবনাক্ততা থাকলেও সুবান্ধি পয়েন্টে লবনাক্ততা নেই। কালেভদ্রে দেখা গেলেও তা খুবই সহনীয় মাত্রায় থাকে।
সুপার সাইক্লোন সিডরের সময় সুবান্ধি পয়েন্টে চাওড়া নদীতে কোন বাঁধ ছিলো না। সুবান্ধি ও জুলেখার স্লুইজগেট থেকে আমতলী পর্যন্ত চাওড়া নদীটির দুপাড়ে ২১টি কার্লভার্ট ও ইনলেটসহ উচু রাস্তা রয়েছে। যে কারনে সুপার সাইক্লোন সিডরে এসব এলাকায় তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
অপরদিকে ১৯৬৭ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড উপজেলার জুলেখা খালে ৫ জলকপাট ও উত্তর টিয়াখালী খালে ৫ জলকপাট এবং ঘুঘুমারিতে ১ জলকপাটের স্লুইজ নির্মাণ করে। সুবান্দি পয়েন্টে ৩ জলকপাট থেকে পানি নিস্কাসনের কারনে নদীর ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলেও জুলেখা, উত্তর টিয়াখালী ও ঘুঘুমারি খালের জলকপাট বন্ধ করে একটি প্রভাবশালী মহল মাছ চাষ করে এবং জাল দিয়ে আটকিয়ে মাছ ধরার কারনে স্বাভাবিক পানি প্রবাহতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এছাড়াও জুলেখার স্লুইজ খালের লক্ষী নামক স্থানে ৩টি বাঁধ, উত্তর টিয়াখালী স্লুইজের খালে বাঁধসহ ওই খালের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
এদিকে নদী সংলগ্ন ১০টি খালে স্থাণীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ এবং দখল করে স্থায়ী বাড়ী ঘর নির্মাণ করছে। এতে চাওড়া নদীর পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে ওই নদী ও শাখা খালগুলোর প্রায় ১৫ কিলোমিটার কচুরীপানা ভর্তি হয়ে জনদূভোর্গ চরম আকার ধারন করেছে। এতে নদীর দু’পাড়ের মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। কচুরীপানার কারনে পানি নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে পরিবেশ দুষিত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে ওই নদী ও খালের পানি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পরেছে। এ নদীর দু’পাড়ের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের জনদুর্ভোগ চুরান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে। এ কারনে ৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার লাখো মানুষ অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে খাল মুক্ত করে নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরন দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
হলদিয়া গ্রামের মোঃ রফিকুল ইসলামসহ একাধিক এলাকাবাসীরা বলেন, মানুষের দূর্ভোগ লাগবে জরুরী ভিত্তিতে খালের মধ্যে থাকা কচুরীপানা অপসারণ করা দরকার। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এ বন্ধ খালগুলোর বাঁধ কেঁটে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার দাবী জানাই।
চাওড়া চন্দ্রা গ্রামের কৃষক মোঃ শানু মিয়া বলেন, চাওড়া নদী ও শাখা খালগুলোতে কচুরীপানা জমে পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এ পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দুর্গন্ধে পরিবেশ দুষিত হচ্ছে। অতিদ্রুত কচুরীপানা অপসারনের দাবী জানাই।
চাওড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আখতারুজ্জামান বাদল খান মুঠোফোনে বলেন, চাওড়া ইউনিয়নবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী সুবান্ধি খাল সংস্কার, ঘটখালী বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণ ও নদী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নেয়ার। দ্রুত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চাওড়াবাসীর দূর্ভোগ লাগব হবে।
উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, চাওড়া খালের স্বাভাবিক পানি প্রবাহের বাঁধাসমূহ দূর করার জন্য ও পায়রা নদীর ভাঙ্গনের হাত থেকে পৌরশহর রক্ষায় পাউবো থেকে যে প্রকল্প দেয়া হয়েছে তা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন, চাওড়া নদীর শাখা প্রশাখায় খালে যে বাঁধগুলো রয়েছে সেগুলো কেঁটে স্লুইজ ও কালভার্ট নির্মাণ করে নৌপথে চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে আমতলীর দৃশ্যপট।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ কায়সার আলম মুঠোফোনে বলেন, চাওড়া নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করন, কচুরীপানা অপসারন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন থেকে আড়পাঙ্গাশিয়া, ঘটখালী ও পৌরশহর রক্ষার জন্য বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭২৬ কোটি টাকা ডিপিপি (ডকুমেন্ট অফ প্রজেক্ট প্রফর্মা) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব মহোদ¦য়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে চাওড়া নদী সংশ্লিষ্ট মানুষসহ উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষের দূর্ভোগ লাঘব হবে।